একটাই আকাশ

একটাই আকাশ
লিয়ানা বদর
অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ

পিচঢালা পথ আর পর্বতদেহের মাঝখানে নুড়িপাথরের বেশ উঁচু একটি স্তুপের উপর ও দাঁড়িয়ে ছিল। নিশ্চল দেহ আর জমাট দৃষ্টিতে ও দাঁড়িয়ে ছিল মোমের পুতুলের মতো। একটি কালো চোখ তখনও দ্যুতিময়! দাবার ছকে বীরযোদ্ধার ক্ষুদ্র প্রতিকৃতির মত ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গি আমার দৃষ্টি কেড়ে নিলো। সামান্য ঝুঁকে ওকে হাতে তুলে নিলাম। পাখি নয়, যেন এক টুকরো জমাট বালু হাতে নিয়েছি আমি। ওর অন্য চোখটি বন্ধ ছিল; পাতা ফুলে পুরো চোখটাকেই ঢেকে দিয়েছে। দুই চোখের মাঝখানে লাল ক্ষতটি আঘাতের স্পষ্ট চিহ্ন, ক্ষতস্থানের নিচের সবগুলো পালক ওঠে গেছে। বুঝাই যায়, কোন এক শিকারি পাখি দুই চোখের মাঝখানে বার বার ঠোকর দিয়েও ওকে পরাস্থ করতে পারেনি। আমার সঙ্গীদের একজন বলল, রাস্তায় খাবার খোঁজার সময় গাড়ির ধাক্কা লেগে থাকতে পারে, পাখিরা সাধারণত চলন্ত গাড়ির উপস্থিতি আঁচ করতে পারে না। আরেক সঙ্গী আমার অনুমানকে সমর্থন করে বলল, ‘বাজ কিংবা চিলের কাজ।’

তিউনিশিয়ান স্টাইলে নীল সুতোয় কারুকাজ করা একটি সাদা রেশমী স্কার্ফ আমার গলায় ছিল। ওটা দিয়ে মুড়িয়ে পাখিটাকে আমি আলতো করে হাতে তুলে নিলাম। ও একটুও ঘাবড়ায়নি। আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম, কারণ বসন্তের পরিবর্তিত আবহওয়ার জন্যই স্কার্ফটা সাথে এনেছিলাম আর একটি আহত পাখির জীবন বাঁচাতে ওটা কাজে লেগেছে। ছোট্ট পাখিটাকে তুলে নিয়ে পাহাড়ের ঢালু পথ ধরে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম; এক টুকরো নীল আকাশ আমাদের পথচলার দর্শক হয়ে আছে। বাসন্ত আকাশের এতো ঔজ্জ্বল্য শীতের ঠান্ডা দিনগুলোর পর এই প্রথম আমার চোখে পড়ল। যতটুকু সম্ভব পাখিটাকে আমি বুকের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করছিলাম। আমার হৃদস্পন্দন থেকে ওর ক্লান্ত দেহ কিছুটা হলেও উষ্ণতা পাবে সে আশায়। একটি আহত পাখি তার ডানায় ভর দিয়ে মধ্যাকর্ষণ জয় করে উঁচু ঢিবিতে উঠেছে, আত্মরক্ষা করেছে। নিঃসন্দেহে ও আমাদের চেয়েও শক্তিশালী।

ইসরাইলি সেনাদের নির্মিত অস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম একটি প্রাণচ্ছ্বোল পথ ধরে। পথটি মৃতপ্রায় ছিল, কারণ গত দেড় মাস ধরে আমাদের শহরকে বিধ্বস্ত করতে আসা দানবীয় ট্যাংক আর সাজোয়া যানগুলো ওই পথ দিয়েই চলাচল করেছে। বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে সেদিন আমাদের পায়ের পাতাগুলোও পথের ছড়ানো-ছিটানো নুড়ি পাথর ভেদ করে একটি মুক্ত নগরীর শক্ত মাটির অস্তিত্ব উপভোগ করছিল। কিন্তু এই মুক্ত পথচলার মাঝেও আমাদের অভিন্ন অনুভূতিকে বারবার ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছিল সেনাদের জিপে লাগানো লাউড স্পিকার থেকে ভেসে আসা সতর্কবার্তাগুলো। প্রাণঘাতি ভাইরাস যেভাবে তরতর করে বংশবৃদ্ধি করে, সেনাদের একই কথার ঘনঘন পুনরাবৃত্তি সেভাবেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল চারপাশে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামনে এগিয়ে যেতে আমরা ছিলাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বিষাক্ত গ্যাস আর কার্ফিউ এর কারণে রাস্তায় জমে থাকা ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ উপেক্ষা করে আমরা হেঁটে চললাম। আসলে, ঘর নামক বন্দীশালা থেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও পালাতে চাইছিলাম আমরা। সেদিনের ওই পদযাত্রা ছিল আমাদের ওপর বর্মের মত চাপিয়ে দেওয়া বিধিনিষেধ থেকে ক্ষণিকের পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা মাত্র। কিন্তু এভাবে ফিলিস্তিনের নীল আকাশ খুঁজতে যেয়ে প্রকারান্তরে আমরা প্রবেশ করছিলাম এক বন্দীশালা থেকে আরেক বন্দীশালায়, এক বিধিনিষেধ থেকে আরেক বিধিনিষেধে। আমরা এমন এক টুকরো আকাশের খোঁজ করছিলাম, যে আকাশ তার সুপ্রাচীন ঔদার্য নিয়ে তাকিয়ে আছে নিচের পার্বত্য ভূমির দিকে। পাথরের দেয়ালে ঘেরা সমুদ্রের ঢেউ-এর মত এই পার্বত্য ভূমি। এখানকার পাথরের দেয়ালগুলো জমিনকে আঁকড়ে ধরে আছে রোমান ও ফিনিশিয় আমল থেকে। দেয়াল আর ছোট ছোট দূর্গের মত পাথরের ঘর। যুগের পর যুগ ধরে এ দেয়ালগুলোই রক্ষা করেছে এ জনপদের ফসল আর ভেড়াগুলোকে। অথচ নতুন প্রজন্ম এই পাথরের ইতিহাস মনে রাখেনি।

পাখিটাকে স্কার্ফে জড়িয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম। আমার এক প্রতিবেশী পাখি পুষেন, তার একটি ছোট খাটো পাখির খামার আছে। তার পরামর্শে আমি আহত পাখিটার নাম রাখলাম রবিন। ওর গলায় অসম্পূর্ণ লাল রেখার কারণে আমি কিছুটা সন্দিহান হলেও পাখিপ্রেমী ওই প্রতিবেশি নিশ্চয়তা দিয়ে বললেন, ‘ওর বয়স কম, তাই রঙটা পুরোপুরি জেগে ওঠেনি।’ পানি ও কিছু শষ্যদানা দিয়ে একটি ধাতব চালুনির নিচে রবিনকে রেখে দিলাম। প্রথম দিন অতিক্রান্ত হলো। ওর শরীর তখনও শক্ত ও নিস্তেজ। শক্ত শরীর নিয়ে ও একবার দাঁড়িয়েছিল বটে, কিন্তু মনে হলো কেউ ওকে আঠা দিয়ে আটকে রেখেছে। চালুনির রঙের সাথে ওর বিবর্ণ শরীরটা এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে খুব ভালভাবে খেয়াল না করলে ওকে দেখাই যেত না। এক সময় আমি একটি হলুদ ক্যানারি পাখি পুষতাম। রবিনের এই অবস্থা দেখে ওই পাখিটির কথা মনে পড়ে গেল। দু’দিন আমি বাড়ির বাইরে ছিলাম। ঝুলন্ত খাঁচাটা যে কোন কারণে নিচে পড়ে যায়। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে পাখিটা এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে দানা-পানি ছাড়াই পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল টানা দু’দিন। এই স্মৃতি থেকে আমি অনুমান করলাম, দু’এক দিন বাদে রবিনও সুস্থ হয়ে ওঠবে। পাখিরা যত ছোটই হোক না কেন ওদেরও প্রকাশভঙ্গি আছে। নড়াচড়ার ধরন দেখে ওদের সুখ-দুঃখ আন্দাজ করা যায়। রবিনের নিথরতা বলছিল ও সুখে নেই। কিন্তু আমি কিছুটা হলেও খুশি ছিলাম, কারণ ও অন্তত একটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে।

পরের দিনও রবিনের কোন নড়চড়া চোখে পড়েনি, তবে সুখের কথা ওর জন্য রাখা শষ্যদানার সংখ্যা কমেছে। আরো তিন দিন অতিক্রান্ত হলো। মূলত ইসরাইলি সেনাদের লাউড স্পিকার থেকে কারফিউ উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা শোনার জন্য ওই তিন দিন আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ওইকটা দিন রবিন নড়াচড়াও করেনি, শব্দও করেনি। আহত চোখটির সামান্য উন্নতি ছাড়া সুস্থতার আর কোন লক্ষণ ওর মধ্যে দেখতে পায়নি। একটু একটু করে ও চোখ খুলছিল বটে তবে তা স্বাভাবিক চোখের মতো ছিল না।

আমি আমার সেই প্রতিবেশির কাছে জানতে চাইলাম, রবিনকে ছেড়ে দেব কিনা। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন: রবিন বন্য পাখি। গৃহবন্দী থাকার যন্ত্রণা খুব বেশিদিন ওর সহ্য হবে না। ভাল হয়– দানা-পানি খাওয়া বন্ধ করে দেবার আগেই ওকে মুক্ত করে দেওয়া।

ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলি সেনাদের সংঘর্ষের আশঙ্কায় রাতে আমার ঘুম আসছিল না। বিছানায় বিশ্রী ভঙ্গিতে শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করলাম, অবশ্য আমার শোবার ধরনটাই এমন। না, ঘুম এলোই না। ভোর বেলায় জেগে থাকার তিক্ততা থেকে বাঁচার জন্য আমার সব রকম চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। এরকম নির্ঘুম ভোর পুরো দিনটাকে মাটি করে দেবার জন্য যথেষ্ট। রাতে জানালা বেশ শক্ত-পোক্ত করেই লাগিয়েছিলাম। কিন্তু সেনাদের লাউড স্পিকারের শব্দ যেন দেয়াল ভেদ করে আমার কানে আঘাত করছিল। একজন ইসরাইলি সেনা ভুল ব্যাকরণে বিকৃত আরবি শব্দে কিছু একটা ঘোষণা করছিল। আরো একটি দিন আমাদের গৃহবন্দী থাকতে হবে নাকি কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হবে– ঘোষণার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারিনি।

সকালটা সুখকর হলো না। অনিদ্রার তিক্ততা শরীর ও মনে সমানভাবে জেকে বসেছে। রবিনকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া এই অবষাদ দূর করার আর কোন উপায় পেলাম না। সেই রৌদ্রজ্জ্বোল দিনে, যেখান থেকে রবিনকে তুলে এনেছিলাম আজ সেখানেই ওকে রেখে আসব। ছোট্ট এই পাখিটাকে আজ নিয়ে যাব ওর আপন দুনিয়ায়Ñ ফিলিস্তিনের সবুজে, ফিলিস্তিনের নীলিমায়।

হাতে সময় খুব একটা নেই। একটু বাদেই কয়েক ঘন্টার জন্য কারফিউ উঠে যাবে। রবিনকে নিরাপদ আশ্রয়ে ছেড়ে এসে বেকারির সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে এবং তারপর গুটি কয়েক শব্জির দোকানেও। ফলে তাড়াহুড়ো করে বান্ধবীকে নিয়ে রওনা হলাম শহরের পশ্চিম দিকে। আমার হাতে রবিন, বড় একটি বাটিতে চালুনি দিয়ে ঢেকে রেখেছি। কিন্তু আজ ওই জায়গাটিকে সেদিনের মত অতো সুন্দর লাগছে না। ইসরাইলিদের বসতি স্থাপনের কাজ পুরো দমে শুরু হয়েছে। নির্মাণাধীণ ভবনগুলোর বিন্যাসে কোন ছন্দ নেই। রাস্তার ধারে লোহা-লক্কর আর ইট-পাথরের ছড়াছড়ি পুরো পরিবেশটাকে দূষিত করে রেখেছে। রবিনকে যেখান থেকে উদ্ধার করেছিলাম তার আশেপাশে কোন একটি নিরাপদ গাছের সন্ধান করছিলাম আমরা, কিন্তু পেলাম না। কন্সট্রাকশন সাইট থেকে বেশ দূরে পাহাড়ের চূড়ায় ছোট একটা পাইন গাছ চোখে পড়ল আমাদের। দেখে মনে হলো, ভুলবসত কাটা পড়ার হাত থেকে রেখাই পেয়েছে গাছটি। রবিনকে নিয়ে আমরা নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে চললাম। ছোট ছোট ব্রাম্বল গাছের কাঁটাগুলো আমাদের কাপড়ে বিধে যাচ্ছিল, যেন আমাদের খামচে ধরতে চাইছে ওরা। কিন্তু নুড়ি পাথর আর ব্রাম্বল কাঁটার আঘাত উপেক্ষা করে পাহাড় চূড়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা আমাদের ছিল। একটি পাখিকে মুক্ত করে দেবার আনন্দের কাছে ওগুলো অতিতুচ্ছ প্রতিবন্ধকতা। আমরা পাইন গাছটির কাছে পৌঁছলাম। আশেপাশের পাহাড়গুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে উঁচু। এই পাহাড়ের চূড়ায় দন্ডায়মান পাইন গাছটিই সম্ভবত রবিনের নিরাপদ আশ্রয়।

আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। দূর থেকে যতটুকু ভেবেছিলাম কাছে আসার পর গাছটিকে ততোটুকু নিরাপদ মনে হলো না। কিন্তু পাথরের গায়ে গজিয়ে উঠা কিছু কাঁটাওয়ালা ঝোপঝাড় ছাড়া আমাদের সামনে কোন বিকল্প ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত রবিনের জন্য ওই পাইন গাছটিকেই বেছে নিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল রবিন ঠিক মতোই পুরো ব্যাপারটা সামলে নেবে কারণ কয়েক দিনের গৃহবন্দীত্ব নিশ্চই ওর সহজাত বন্য স্বভাব নষ্ট করে দেয়নি! পাইন গাছের একটি নিচু ডালে রবিনকে বসিয়ে দিলাম। আমাকে হতাশ করে দিয়ে রবিন মাটিতে পড়ে গেল। গাছের ডালটি ও খামচে ধরতে পারেনি। দৌড়ে গিয়ে ওকে আরেকটি ডালে বসিয়ে দিলাম। পাখি হয়েও রবিন গাছের ডালে বসতে পারছে না। এর অর্থ হলো ওর স্নায়ুবৈকল্য পুরোপুরি কাটেনি। কিন্তু তারপরও বিকল্প কিছু করার সুযোগ আমাদের কাছে ছিল না। ভারসাম্য হারিয়ে রবিন যতবারই পড়ে যাচ্ছিল আমি ততবারই ওকে তুলে গাছের ডালে বসিয়ে দিচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে ও নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো, তবে খুব বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনি, আবারও মাটিতে পড়ে গেল।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল, তবে হাল ছেড়ে দেবার অবকাশ নেই। এই বিলম্ব বিপদের কারণ হবার আগেই এখান থেকে আমাদের ফিরে যেতে হবে। এ দফায় রবিনের চেষ্টায় কিছুটা উন্নতি দেখা গেল। ডালে বসে থাকার স্থায়ীত্ব কিছুটা বেড়েছে এবং পড়ে যাবার সময় ও উড়াল দেবারও চেষ্টা করছে। বাস্তবতা হলো, রবিনকে সাথে নিয়ে আমি বাড়ি ফিরতে পারবো না এবং ওকেও খুব দ্রুত উড়াল দেবার শক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে আমরা চলে যাবার পর ওকে বিড়ালের পেটে যেতে হবে। আশেপাশের জনবসতির বিড়ালগুলোর এদিকে আনাগোনা আছে।

সপ্তম বারের চেষ্টায় রবিন কিছুদূর উড়ে মাটিতে পড়ে গেল। এরপর আরো কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা। যদ্দুর মনে পড়ছে, দশম বারের বেলায় রবিন উড়াল দিল।
হ্যাঁ, রবিন উড়লো।

খুব বেশি উঁচু দিয়ে নয়। তবে এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য ওই উচ্চতা যথেষ্ট ছিল।

অবশেষে রবিন উড়লো এবং আমাদের দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেল।

সেদিনের থেকে আর কখনই আমি রবিনকে দেখিনি।

যে বসন্তে ডানা ঝাপটিয়ে রবিন অদৃশ্য হয়ে গেল, সেই বসন্তের শেষ দিকে আমি আরো একবার ওই জায়গাটায় গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম ওই একই উদ্দেশ্যে, ফিলিস্তিনের একখন্ড মুক্ত আকাশের খোঁজে। সেদিন এমন একটা কিছু আমার দৃষ্টিগোচর হলো যা আগেও বহুবার হয়েছে, কিন্তু আমার বোধের জগতে নাড়া দেয়নি। কিন্তু সেদিন দিলো, সংগত কারণেই দিলো। একটি শিকারি পাখি অনেক উঁচুতে ফিলিস্তিনের মুক্ত আকাশে হেলিকপ্টারের মতো চক্কর দিচ্ছিল। নিখুত ধ্যানে সে শিকার খুঁজছে, তার শিকারটি হয়তো রবিনের মতোই ছোট্ট কোন পাখি! আমি বুঝতে পারলাম, এই পার্বত্য ভূমির আকাশে পুরোটা দিন সে ব্যয় করেছে ওই ছোট্ট গাছটির উপর চক্কর দিয়ে। আসলে, প্রতিটা শিকারিই জানে তার শিকার কোথায় থাকে!
একটি সুউচ্চ পার্বত্যভূমি, যার পাহাড়চূড়া ও জলপাই গাছগুলোর দিকে এক টুকরো নীল আকাশ তাকিয়ে আছে সহ¯্র বছর ধরে। সমুদ্র দর্শনে বিমুগ্ধ সেই পার্বত্যভূমি প্রাচীন যুদ্ধের ইতিহাস বহন করে বার বার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে উপনিবেশের আঘাতে। বুনো লতারা এখনো খামচে ধরে কৃষকের বহু পুরনো পাথর-বাড়ি আর সমুদ্রের পাড়ে একের পর এক বাসা বাধে নগরী। যুগের পর যুগ যুদ্ধ চলে, অধিবাসীরা নগরী ছাড়ে এবং থিতু হয় অনাহুত অধিবাসী।

এসবই ঘটে একই আকাশের নিচে।

এজন্যই আমার দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে কী রবিন উড়ে গেছে দূরে!

 

Liana Badr

 

লিয়ানা বদর: লিয়ানা বদর একজন স্বনামধন্য ফিলিস্তিনি ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। একই সাথে তিনি কবি, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালকও। তার জন্ম ১৯৫০ সালে, জেরুজালেমে। দর্শন ও মনোবিজ্ঞান নিয়ে তিনি অধ্যয়ন করেছেন জর্ডান ও বেইরুত বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘আ কম্পাস ফর সানফ্লাওয়ার’। ‘আ ব্যালকনি ওভার দ্য ফাকিহানি’ এবং ‘দ্য আই অব দ্য মিরর’ তার প্রকাশিত পাঁচটি উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। লিয়ানা বদর-এর অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে চারটি ছোটগল্প সংকলন, দু’টি কাব্য ও চারটি প্রবন্ধ সংকলন। অনূদিত এই গল্পটি বিখ্যাত সাময়িকী বানিপালে প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে বেকি ম্যাডক এর ইংরেজি অনুবাদে।

মন্তব্য করুণ [Comment]