ইরাকী গল্প: দেহ

ইরাকী গল্প: দেহ
সালিমা সালিহ
অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ

আজকের সকালটা অন্য সকালগুলোর মত নয়। ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে ট্যাক্সিচালকের নিস্ফল চ্যাচামেচির সাথে সুর মেলানো কিংবা রাস্তাঘেষা প্রাচীরের ওপাশ থেকে উঁকি দেওয়া ফলবতি কমলাগাছগুলোর সৌন্দর্য দর্শনের আগ্রহ আমিন আল-কাশেমির আজ নেই। তিনি চিন্তামগ্ন। একটি জীবনকে তিনি আজ কল্পনায় পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। ওই জীবনের সবটুকুইÑ প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ। তার মগ্নতা প্রমাণ করে, স্মৃতির পুনর্বিন্যাস শেষ না করে তিনি থামবেন না। তার আশঙ্কা, সামান্য অমনোযোগিতার জন্য একটুকরো স্মৃতিও যদি হারিয়ে যায় তাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। স্মৃতি পুনরুদ্ধারের এই কাজটি শেষ করার পরেই কেবল ‘রেকর্ড ক্লোজড’ শব্দ দুটি জুড়ে দিয়ে আজ আরো একটি ফাইলকে তিনি সারা জীবনের জন্য শেলফে তুলে রাখতে পারবেন। কারো মৃত্যু সনদ অফিসে পৌঁছলে এ কাজটি তাকেই করতে হয়। নগর প্রশাসনের নিবন্ধন বিভাগে কাজ করার কারণে বিগত দশ বছরে এই দাপ্তরিক শব্দ দুটি তাকে অসংখ্যবার লিখতে হয়েছে। বছরের পর বছর শব্দ দু’টি তিনি লিখে গেছেন কিন্তু এগুলোর অর্থ নিয়ে কখনই মাথা ঘামাননি। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে, তাদের মা, স্ত্রী-সন্তান কিংবা তাদের সাফল্য, ব্যর্থতা ও আকাক্সক্ষা নিয়েও তিনি কখনও চিন্তা-ভাবনা করেননি। কিন্তু আজ সকালে, যে সকালটি অন্য সকালগুলোর মত নয়, আমিন আল-কাশেমি আবিস্কার করেছেন, ভাবলেশহীনভাবে ‘রেকর্ড ক্লোজড’ শব্দ দুটি তার পক্ষে আজ আর লেখা সম্ভব নয়। কারণ আজ যে ব্যক্তির মৃত্যু সনদ তাকে গ্রহণ করতে হবে সে তারই পুত্র সন্তান।

আজ সেই শিশুটিকে নিয়ে তাকে ভাবতে হচ্ছে যাকে দিনের পর দিন তিনি কোলে নিয়ে আদর করেছেন, যে একসময় কয়েকটি অর্থহীন ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই উচ্চারণ করতে পারতো না; যাকে অর্থপূর্ণ শব্দ শেখাতে তাকে দিনের পর দিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। আজ তাকে সেই নাবালক ছেলেটির কথা ভাবতে হচ্ছে, যার নরম হাত ধরে তিনি কফি হাউজে যেতেন। আজ তার মনে পড়ছে সেই মুহূর্তগুলোর কথা যখন কোন কারণে ভয় পেয়ে বাড়ি ফিরলে তিনি ছেলেকে বলতেন, ‘বাবা, বড় হতে শেখো।’ কিন্তু তার সেই ছেলেটি কখনই বড় হয়ে উঠেনি। বাবার চোখে সন্তানরা কখনই বড় হয়ে উঠে না। তার কাছে সে তো শুধুই আঠারো বছরের এক কিশোর, যে সবেমাত্র দাড়ি কামাতে শিখেছে। তিনি আজ সেই কিশোরের কথাই ভাবছেন যে তাকে একদিন বলেছিল, ‘তুমি কি মনে কর আমি এখনও ছোট-ই রয়ে গেছি?’ আমিন আল-কাশেমি সেই দিনটির কথা ভাবছেন, যেদিন তিনি আবিস্কার করেছিলেন তার কিশোর ছেলেটি তার কাছেই অচেনা। তিনি নিজের ছেলেকে না যতটুকু চিনেন তার চেয়ে বেশি চিনেন প্রতিবেশির ছেলেদের। তিনি সেই ছেলেটির কথা ভাবছেন, যাকে আজ চিরদিনের জন্য বাড়ি নিয়ে যাবেন।

আজকের এই ব্যতিক্রমী সকালে আমিন আল-কাশেমি’র হৃদয়ে ক্রোধের আগুন জ্বলছে। তার ক্রোধ সেই বুলেটের প্রতি যেটি তার ছেলের দেহ ভেদ করেছে। ক্রোধ তাকে বলছে চিৎকার করে কাঁদতে, ঘাতকের দিকে অস্ত্র তাক করতে। কিন্তু দুঃখের দহন ক্রোধের দহনের চেয়েও বেশি জ্বালাময়ী। তিনি কিছুই করলেন না। তিনি প্রতিশোধের নিস্ফলতা নিয়ে ভাবলেন, একটি জীবনের নিস্ফলতা নিয়েও ভাবলেন। আজ অবধি তিনি যা করেছেন সবই এখন অর্থহীন। আজকের পর থেকে ‘আবু মু’তাসিম’ বলে কেউ কাউকে ডাকবে না। তিনি বিধ্বস্ত, ব্যাথিত। অবশ্য এই ব্যাথা তার চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রুও ঝরাতে পারেনি।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিরবতাই সবচেয়ে বড় সান্ত¡না-বাণী। পুরো যাত্রাপথে তিন জনের এক জনও কোন কথা বললেন না। প্রচন্ড জ্যাম সত্বেও ট্যাক্সি ড্রাইভার দ্বিতীয়বার চ্যাচামেচি করেননি আর সঙ্গে থাকা আমিন আল-কাশেমি’র ভাইও অনর্থক জানতে চাননি কোথায়, কখন, কিভাবে ঘটনাটি ঘটেছে।

ভাইকে সাথে নিয়ে আমিন আল-কাশেমি সামরিক হাসপাতালে প্রবেশ করলেন। এক গোছা চাবি নিয়ে এগিয়ে এসে একজন সেনারক্ষী তাদের অপেক্ষা করতে বললেন। করিডোরের ডানপাশের লোহার দরজাটি খোলা হলো। বড় হল ঘরটির দু’পাশের দেয়াল ঘেষে সমান্তরাল দু’টি সারিতে অনেকগুলো মৃতদেহ সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন সেখান থেকে সবগুলো দেহই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সিলিং-ঘেষা ছোট ছোট জানালা দিয়ে আলো ঢুকে বিপরীত দিকের দেয়ালগুলোতে প্রতিফলিত হচ্ছে। এই আলোতেই কালো মেঝের উপর সাদা কাপড়ে ঢাকা মৃতদেহগুলো হয়ে উঠেছে দ্যুতিময়।

ইতোমধ্যে একজন সার্জেন্ট উপস্থিত হয়েছেন। লোহার দরজাটি খোলার পর ওই সার্জেন্ট আর সেনারক্ষী এমনভাবে একপাশে সরে দাঁড়ালেন যাতে আগতরা ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। হাতে থাকা নামের তালিকায় চোখ বুলিয়ে সামনে অপেক্ষমান লোকগুলোর দিকে সার্জেন্ট পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর নিরবতা ভেঙ্গে আমিন আল-কাশেমির নাম উচ্চারণ করে তাকে সামনে এগিয়ে আসতে বললেন। আমিন আল-কাশেমি দুই কদম এগিয়ে এসে তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত করলেন এবং জানালেন, তিনিই ‘মু’তাসিম আল-কাশেমি’র বাবা। সার্জেন্ট আরেকবার নামের তালিকাটি দেখলেন এবং একটি জায়গায় হাতের আঙুল বসিয়ে আমিন আল-কাশেমিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘নাম্বার ফোর।’ সার্জেন্ট নিজে প্রথমে ঘরে প্রবেশ করলেন আর ভাইকে সাথে নিয়ে আমিন আল-কাশেমি ধীর পায়ে তাকে অনুসরণ করলেন। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে তিনি প্রাণপণে আবেগ দমন করার চেষ্টা করছিলেন। চতুর্থ মৃতদেহের ওপর থেকে ময়লা কাপড়টি সরিয়ে আল-কাশেমিকে সার্জেন্ট প্রশ্ন করলেন:‘এটাই কি আপনার ছেলে?’

ওটা যে তার ছেলের মৃতদেহ নয় এটা বুঝতে আমিন আল-কাশেমিকে দ্বিতীয়বার তাকাতে হয়নি। কালো মেঘের মত মুখটায় যেন দুঃস্বপ্নের ঝাপটা লেগেছে। তার ঘাড়ে, ঠিক কানের নিচে একটি বড়সড় গর্ত। গুলিটা ওদিক দিয়েই ঢুকেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই আমিন আল-কাশেমি মাথা ঝাঁকালেন। সার্জেন্ট চমকে উঠলেন:‘এটা আপনার ছেলে নয়?’ ‘না,’ ক্ষীণ কন্ঠে আল-কাশেমি জবাব দিলেন।

মৃতদেহের মুখ ঢেকে দিয়ে সার্জেন্ট কাপড়ের এক কোণা টেনে কিছুটা উপরে তুললেন। বড় বড় কালো অক্ষরে ওখানে নিহতের নাম লেখা ছিল। আমিন আল-কাশেমি লক্ষ করলেন, নামের ঠিক নিচেই বিশ্রি করে লেখা রয়েছে ‘পলাতক।’ তার বুকটা ধুপ করে কেঁপে উঠলো; কিন্তু তিনি অবিচল রইলেন। নামের দিকে আনমনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সার্জেন্ট এর একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করলেন। ‘কাপড়গুলো নিশ্চই এদিক-ওদিক হয়েছে। আসুন, অন্যগুলো দেখি।’ তিনি আল-কাশেমিকে নিয়ে প্রথম মৃতদেহের কাছে গেলেন; মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে আল-কাশেমির দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আল-কাশেমি এবারও মাথা ঝাঁকালেন। সার্জেন্ট পাশের মৃতদেহের কাছে গেলেন, মুখের ওপর থেকে কাপড় সরালেন। ‘এটাও আমার ছেলে নয়,’ আল-কাশেমি জবাব দিলেন। সার্জেন্ট দমে গেলেন না। তৃতীয়টি দেখিয়ে চতুর্থ মৃতদেহের কাছে গিয়ে মন্তব্য করলেন, ‘এটা আগেই দেখেছেন।’ পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম দেহটিও তিনি দেখালেন কিন্তু আল-কাশেমি প্রতিবারই নেতিবাচক সাড়া দিলেন।

‘আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার ছেলের দেহ খুঁজে বের করবই। আমি নিশ্চিত যে ভুলবসত কাপড়গুলো ওলট-পালট হয়েছে।’ এসব কথা বলতে বলতে সার্জেন্ট শেষ মৃতদেহটির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন তার প্রতিশ্রুতি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। শেষ মৃতদেহের কাছে এসে দাঁড়াবার পর তার মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল তিনি আল-কাশেমিকে তা বুঝতে দিলেন না। কাপড় সরাতে সরাতে তিনি বললেন, ‘এটাই শেষ দেহ, এটা নিশ্চই আপনার ছেলের।’ আল-কাশেমি ছেলেটির মুখের দিকে তাকালেন। খুব বেশিদিন হয়নি ও বয়ঃসন্ধি পেরিয়েছে। তার ধারণা এই ছেলের বয়স বড়জোর ষোল হবে। হালকা-পাতলা গড়নের ছেলেটির মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে খুব শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। আল-কাশেমির তাকিয়ে থাকা দেখে সার্জেন্ট ভাবলেন, তার মিশনের সফল সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। কিছুটা প্রশান্তির কন্ঠে আনমোনা আল-কাশেমিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটাই আপনার ছেলে, তাই না?’ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে টিমটিমে আশার আলো জাগিয়ে রেখে আল-কাশেমি আগের মতই মাথা ঝাঁকালেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, তার ছেলে এখনও বেঁচে আছে আর এতক্ষণ যা যা ঘটেছে তা মারাত্মক ভুল: ‘না, ও আমার ছেলে না।’

সার্জেন্ট কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লেন: ‘এটা হতেই পারে না। নামটা আরেকবার বলুন তো?’ এই বলে তিনি নামের তালিকাটি আবারও বের করলেন। কাগজটি তার সামরিক পোশাকের পকেটে ছিল। তিনি বলতে শুরু করলেন: ‘মু’তাসিম আল-কাশেমি। নাম্বার ফোর। ভুল হবার কোন সুযোগই নেই।’ কাগজটি ভাজ করে পকেটে ভরে তিনি দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। বললেন, ‘আমার সাথে আসুন।’ ভাইকে সাথে নিয়ে আমিন আল-কাশেমি তাকে অনুসরণ করলেন। সার্জেন্ট লোহার দরজাটি তালাবদ্ধ করে লম্বা করিডোর ধরে এগিয়ে গেলেন। দরজার কাছে আরো দু’জন ব্যক্তি অপেক্ষায় ছিলেন, তিনি তাদের দিকে তাকাবারও অবসর ফেলেন না। করিডোরের শেষ মাথায় পৌঁছে বামে মোড় নিয়ে তারা তিনজন ছোট্ট একটি অফিস রুমে ঢুকলেন। একটি টেবিল, চেয়ার আর ফাইলে ভর্তি একটি শেলফ ছাড়া আর তেমন কিছুই ওই রুমে ছিল না। টেবিলের ওপর একটি ফাইল আগে থেকেই রাখা ছিল। ওটা হাতে তুলে নিয়ে তিনি দ্রুত কাগজ উল্টাতে শুরু করলেন। ফাইল থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই চেয়ারটা টেনে বসলেন আর কাগজের পর কাগজ উল্টাতে থাকলেন। কাক্সিক্ষত কাগজটি খুঁজে পাওয়ার পর তিনি থামলেন। খোলা ফাইলটা টেবিলে রেখে হাতের তালু দিয়ে কাগজটিকে কয়েকবার ঘষে নিলেন যাতে বাতাসে উল্টে না যায়। তিনি পড়তে শুরু করলেন: ‘মু’তাসিম আমিন আল-কাশেমি, জন্ম ২১ জুলাই ১৯৭১, আল-আমিন কোয়ার্টার, ৭৬ ওকাবা বিন নাফি স্ট্রিট।’ তিনি আমিন আল-কাশেমিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তথ্যগুলো কি ঠিক আছে?’ ‘ঠিক আছে,’ আমিন আল-কাশেমি বললেন। ‘আপনার ছেলেকে কবে সেনাবাহিনীতে তলব করা হয়েছিল?’ সার্জেন্টের পরের প্রশ্ন। আল-কাশেমি জবাব দিলেন, ‘গত বছরের মার্চে। মার্চের আট তারিখে।’

‘কোন ভুল হয়নি। ঠিকানা যেহেতু ঠিক আছে, আমাদের কোন ভুল হয়নি,’ সার্জেন্ট বললেন। আরো কয়েকটি পাতা উল্টিয়ে হাতে লেখা কয়েকটি লাইন তিনি পড়ে শুনালেন: ‘এপ্রিলের ৫ তারিখ, ফ্রন্ট লাইন শান্ত ছিল। বিগত তিন দিনে কেউ কোন গুলির শব্দ শুনেনি। একজন লক্ষ করলেন, রাতের অন্ধকারে পাঁচজন সৈনিক চুপিসারে তাদের স্টেশন ত্যাগ করছে। কিন্তু স্টেশন ত্যাগ করার কোন নির্দেশ তাদের প্রতি ছিল না। সুতরাং তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবার চেষ্টা করছিল। পার্শ্ববর্তী এরিয়ার দায়িত্বরত একজন সৈনিক তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে গুলিবর্ষণ করে। ফলে তারা তাদের কাপুরুষোচিত কাজের পরিণতি ভোগ করে। পরবর্তীতে তাদের দেহ সংশ্লিষ্ট এরিয়া কমান্ডারের কাছে হস্তান্তর করা হলে তিনি প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত করেন। তারা হলো: নাবিল আব্দ আল-হামিদ, বাধ্যতামূলক নিযুক্তি, ১২ প্যালেস্টাইন স্ট্রিট; সামি আল-তালিব, আল-সালাম কোয়ার্টার; মু’তাসিম আল-কাশেমি, আল-আমিন কোয়ার্টার, ৭৬ ওকবা বিন নাফি স্ট্রিট…’ সার্জেন্ট এভাবেই একের পর এক নাম-ঠিকানা পড়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু সেদিকে আল-কাশেমি’র কোন মনোযোগ ছিল না। কারণ তার ছেলের জীবিত থাকার ক্ষীণ আশা আর সামরিক হাসপাতালে তাকে তলব করা নিছক ভুল বুঝাবুঝি ছাড়া আর কিছুই নয়Ñ তার এই বিশ্বাস ততক্ষণে ফিকে হয়ে গেছে।

সার্জেন্ট উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি বরং আরেক বার দেখুন। আমাদের ভুল হবার কোন সুযোগই নেই। আপনার ছেলের নাম এই ফাইলেও আছে, মৃতদেহের সাথে পাঠানো তালিকাতেও আছে। সব মিলিয়ে চৌদ্দজন সেনার মৃতদেহ ওই রুমে ছিল এবং প্রত্যেকের নাম স্পষ্টাক্ষরে এই তালিকায় লেখা আছে।’

আল-কাশেমি ও তার ভাইকে নিয়ে সার্জেন্ট আবার সেই হলরুমের কাছে পৌঁছলেন। মৃতদেহ নিতে আসা অপেক্ষমানদের সংখ্যা ততক্ষণে পাঁচে গিয়ে ঠেকেছে। লোহার দরজা ঠেলে তারা তিনজন আবারও ভিতরে প্রবেশ করলেন। চতুর্থ মৃতদেহের সাদা কাপড়ে যেখানে নাম লেখা ছিল সে অংশ আলতো করে টেনে ওপরে তুলে সার্জেন্ট বললেন, ‘আপনি নিজেই দেখুন।’ তিনি মৃতদেহের মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিলেন। আল-কাশেমি মৃত সৈনিকের মুখের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন এই প্রথম তিনি তাকে দেখছেন। হতাশা ভরা ভারি কন্ঠে তিনি বললেন, ‘ও আমার ছেলে নয়।’

লাশের মুখ ঢেকে দিতে দিতে সার্জেন্ট বললেন, ‘পার্থক্য কোথায়? জীবিত অবস্থায় ওদের কেউ কেউ দায়িত্ব পালন করেছে আর কেউ কেউ করেনি। কিন্তু মৃত্যুর পর তারা প্রত্যেকেই সমান, প্রত্যেকেই এক-ই।’ সন্তানের মৃতদেহ গ্রহণ করার জন্য বাইরে অপেক্ষমান লোকের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কোন উপায়ে আল-কাশেমির ইস্যুটি সার্জেন্ট এখনই শেষ করতে চান। অধৈর্য হয়ে তিনি বললেন, ‘শুনুন, এই যুবকই আপনার ছেলে। এখানে অন্য কিছু ঘটার সুযোগ নেই। তালিকায় চৌদ্দজনের নাম আছে, এই ঘরে চৌদ্দজনের মৃতদেহ ছিল। এটা যদি আপনার ছেলের মৃতদেহ না হয়, তবে এটা কার?’

হঠাৎ করেই সার্জেন্টের কেন যেন মনে হলো আল-কাশেমি চতুর্থ মৃতদেহটিকে তার ছেলে বলে স্বীকার করতে চাইছেন না। সম্মুখ সমর থেকে কাপুরুষের মত পালিয়ে আসা পুত্রের কলঙ্কের দায় তিনি হয়তো নিতে চাইছেন না। এ ধারণা বদ্ধমূল হবার পর তিনি কঠোর হলেন; বললেন, ‘শুনুন জনাব, এটাই আপনার ছেলে। যা ঘটেছে তা দুঃখজনক, কিন্তু আপনাকেই এই অপরাধের দায় বহন করতে হবে। আপনি আপনার ছেলেকে সঠিক শিক্ষায় বড় করতে পারেননি।’ আল-কাশেমি বুঝতে পারলেন পরিস্থিতি ভিন্ন মোর নিচ্ছে। এরকম কিছু একটা যে ঘটতে পারে সে আশঙ্কা তিনি আগেই করেছিলেন। তিনি ভাইয়ের দিকে তাকালেন। তার ভাই ইঙ্গিতে বিষয়টি এখানেই শেষ করার পরামর্শ দিলেন। দুই ভাই একসাথে চতুর্থ মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেলেন। সার্জেন্ট বললেন, ‘মৃতদেহ গ্রহণ করার প্রমাণ স্বরূপ এই কাগজে স্বাক্ষর করতে হবে।’ সার্জেন্টের দেখিয়ে দেওয়া স্থানে স্বাক্ষর করে আল-কাশেমি আবার তার ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। দুই ভাই মৃতদেহটি নিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলেন। ভাড়া করা ট্যাক্সিটি সেখানে-ই অপেক্ষা করছিল।

সালিমা সালিহ

লেখক পরিচিতি: ইরাকি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক ও চিত্রশিল্পী সালিমা সালিহ’র জন্ম ১৯৪২ সালে, মসুলে। বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও বাগদাদ চারুকলা ইনস্টিটিউটে চিত্রশিল্প ও সঙ্গীত নিয়ে অধ্যয়ন করার পর সাংবাদিকতার উপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন জার্মানির লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীতে ‘গণমাধ্যমের বৈশ্বিক প্রবণতা’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইডি ডিগ্রি অর্জন করেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে জার্মানিতে বসবাসকারী এই লেখিকার ছয়টি ছোটগল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া জার্মান থেকে আরবি ভাষায় তার অনূদিত বইয়ের সংখ্যা চৌদ্দটি। বিখ্যাত সাময়িকী বানিপালে প্রকাশিত এই গল্পটি আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সোফিয়া ভাসালু।

মন্তব্য করুণ [Comment]