চতুর্মাসিক যমুনা: উন্নয়ন সংগঠক জাকির হোসেন সংখ্যা

Final Cover Page02-1

::বিদ্যুত খোশনবীশ::

প্রতি চার মাস অন্তর টাঙ্গাইল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয় সৃজনশীল সাহিত্যের কাগজ ‘যমুনা’। সাহিত্যের কাগজ হলেও যমুনা’র সাম্প্রতিক সংখ্যাগুলো প্রকাশিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিথযশা ব্যক্তিত্বের জীবন ও কর্মের উপর আলোচনা-ধর্মী লেখা নিয়ে। পত্রিকাটির সপ্তম ও অষ্টম সংখ্যা দুটি প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে মুক্তিযুদ্ধকালীন কাদেরীয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান আনোয়ার-উল আলম ও সত্তর দশকের অন্যতম কবি মাহমুদ কামালকে নিয়ে। তাঁরা দু’জনই দেশ বরেণ্য, টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তান। সম্ভবত এরই ধারাবাহিকতায় চতুর্মাসিক যমুনা’র নবম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে টাঙ্গাইলের আরেক কৃতি ব্যক্তিত্ব, উন্নয়ন সংগঠক জাকির হোসেন-এর জীবন ও কর্মের উপর আলোকপাত করে।

জাকির হোসেন দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বুরো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। নিজের উদ্ভাবনী শক্তি ও পরিশ্রমের মিশেলে গত সাতাশ বছর ধরে এদেশের উন্নয়নকামী মানুষের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা সৃষ্টির জন্য তিনি কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। বুরো বাংলাদেশের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণসহ বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সেবা প্রদান, বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সংস্থার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করা ও বিভিন্ন মানবসেবামূলক কর্মকান্ডে সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন একজন নেপথ্য কর্মী হিসেবে। দেশের মানুষের জীবনমান পরিবর্তনে তার এই নিভৃত আত্মনিয়োগ ফলপ্রসু হলেও সুদীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন পর্দার ওপাশে। ফলে তার সংগ্রামী ব্যক্তি জীবন ও ঐশ্বর্যময় কর্ম জীবন খুব কমই আলোচিত হয়েছে। এই অনালোচিত থেকে যাওয়াটা সম্ভব হয়েছে তার স্বভাব গুণে, কারণ যদ্দুর জানি তিনি প্রচারবিমুখ মানুষ। একজন শিল্পীর কাছে তার ব্যক্তিসত্তার চেয়ে শিল্পীসত্তার গুরুত্ব যেমন বেশি, জাকির হোসেনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক তাই। কারণ তিনিও একজন শিল্পী, বলা যায়- উন্নয়ন শিল্পী। চতুর্মাসিক যমুনার সম্পাদনা পরিষদ জাকির হোসেনের এই অকৃত্রিম শিল্পীসত্তাকেই সম্মান দিতে চেয়েছেন বলে প্রতিয়মান হয়েছে।

‘উন্নয়ন সংগঠক জাকির হোসেন সংখ্যা’র জন্য লেখা আহ্বান করে প্রেরিত চিঠিতে সম্পাদক লিখেছিলেন, ‘…দারিদ্র্য বিমোচনের এই সংগ্রামের একজন নেপথ্য নায়ক হিসেবে বিগত সাতাশ বছর ধরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক জনাব জাকির হোসেন। চতুর্মাসিক যমুনা’র সম্পাদনা পরিষদ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের মাধ্যমে এই প্রচারবিমুখ অথচ সফল উদ্যোক্তা ও উন্নয়নকর্মীর জীবন ও কর্মের ওপর সামান্য আলোকপাত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’ একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘… ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বুরো টাংগাইল। প্রযুক্তি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ প্রদান তথা মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তিই সংগঠনটির মূল লক্ষ্য। এটি প্রতিষ্ঠা করেন জাকির হোসেন। … তিনি একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। বর্তমানে স্বাধীন দেশের অসহায় মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বুরো বাংলাদেশ-এর মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন। … চতুর্মাসিক যমুনা’র বর্তমান সংখ্যাটি নিভৃতচারি এ উন্নয়নকর্মীর বর্ণিল জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বাংলাদেশ ও ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যায়নধর্মী লেখা দিয়ে সাজানো হয়েছে।’

পত্রিকাটির ভেতর-বাহির পরখ করে সম্পাদকীয় বক্তব্যের যথার্থতাও খুঁজে পাওয়া যায়। মোস্তাফিজ কারিগরের চমৎকার প্রচ্ছদে নবম সংখ্যায় স্থান পেয়েছে আশি জন লেখকের লেখা। যমুনার এ সংখ্যায় যারা লিখেছেন তাদের অধিকাংশই নিয়মিত লেখক নন কিন্তু প্রতিটি লেখার তথ্যমূল্যের পাশাপাশি প্রাঞ্জলতাও পাঠককে মুগ্ধ করবে।

যমুনা’র জাকির হোসেন সংখ্যাটি শুরু হয়েছে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপার্সন স্যার ফজলে হাসান আবেদ-এর শুভেচ্ছা বাণী দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে জাকিরকে চিনি একজন চমৎকার ও দক্ষ সংগঠক হিসেবে। দেশে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহের নেটওয়ার্কিং সংস্থা এডাব এবং পরবর্তীতে এফএনবি গঠন প্রক্রিয়ায় তাকে সবসময় সক্রিয় দেখেছি। বিশেষ করে, বর্তমান পর্যায়ে এফএনবি-কে আরও কার্যকর ও গতিশীল করার ক্ষেত্রে দেশব্যাপী তার নিরবিচ্ছিন্ন শ্রম এবং সাংগঠনিক কর্মকান্ড আমাকে মুগ্ধ করেছে।’

Interview2

সংখ্যাটিকে সাজানো হয়েছে ‘জাকির হোসেন সম্পর্কে অণুগদ্য’, ‘স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন’,‘ নিবেদিত কবিতা’, ‘জাকির হোসেন রচিত লেখা’, ‘সাক্ষাৎকার’, ‘জীবনপঞ্জি’, ‘এক নজরে বুরো বাংলাদেশ’ ও ‘স্থিরচিত্রে জাকির হোসেন’ বিভাগগুলো দিয়ে। ‘জাকির হোসেন সম্পর্কে অণুগদ্য’ নামক অণু বিভাগে স্থান দেওয়া হয়েছে দেশ ও দেশের বাইরের আট জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলোকে। বিভাগটি বর্তমান সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ বিভাগে লিখেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্ণর ড. আতিউর রহমান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধূরী, উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইব্রাহিম, সিপিডি’র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নিজেরা করি’র প্রধান নির্বাহী খুশি কবির, ভারতের বন্ধন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র শেখর ঘোষ এবং পরিবেশ অধিকার কর্মী ও বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী লিখেছেন, ‘জাকির হোসেন একজন উদ্যোক্তা, একজন সমাজকর্মী। সুবিধা-বঞ্চিত মফস্বলের নারী-পুরুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে সমাজকে পরিবর্তন করার তীব্র আকাক্সক্ষা তার মধ্যে বর্তমান।’ ড. আতিউর রহমান জাকির হোসেনের ভূয়সী প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘…বাংলাদেশের আজকের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তা সম্ভব হয়েছে মূলধারার নীতি নির্ধারকদের পাশাপাশি জনাব জাকির হোসেনের মত কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষের মেধা, শ্রম ও দূরদৃষ্টির যুগপৎ সমাবেশের মাধ্যমে।’

স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন বিভাগে স্থান পেয়েছে কবি বুলবুল খান মাহবুব, আনোয়ার উল আলম, পশ্চিমবঙ্গের কবি কমল চক্রবর্তী, ড. মাহবুব সাদিক, মো. আতিকুন্নবী, সুখেন্দ্র কমার সরকার, শিব নারায়ন কৈরী, গ্রাহাম রাইট, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, ড. এম এ ইউসুফ খান, খান মোহাম্মদ খালেদ, খন্দকার নাজিম উদ্দিন, মাহমুদ কামাল, মোহাম্মদ আব্দুল মাননান, আবু মাসুম, শুচি সৈয়দ, রোকেয়া ইসলাম, নীহার সরকার, ফেরদৌস সালাম, মোস্তাফিজ কারিগরসহ অনেক বিশিষ্ট জনের লেখা। আনোয়ার উল আলম মুক্তিযুদ্ধে জাকির হোসেনের অবদান স্মরণ করে লিখেছেন, ‘আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাকির হোসেনের ছিল একটা বিরাট অথচ গোপন ভূমিকা। তিনি টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর জানবাজ পার্টি অর্থাৎ গ্রেনেড পার্টির সাথে সক্রিয় সহযোগিতায় ছিলেন। … তিনি দেলদুয়ারের মিলুর মাধ্যমে আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করতেন এবং হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর উপর নিক্ষেপ করতে সহায়তা করতেন।’ পশ্চিমবঙ্গের ভালোপাহাড়ের কবি কমল চক্রবর্তীর লেখাটির শিরোণাম ‘পালক মাথায় মানুষ।’ চমৎকার লিখন শৈলিতে তিনি লিখেছেন, ‘গরিব মানুষের পাশে অনিবার্য, জাকির, এক আশ্রয়! এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে শিরদাড়া সোজা লড়াই, জাকির! অভাবের সঙ্গে পাঞ্জা, জাকির! প্রতিনিয়ত আরও দুর্মর, জাকির!’ কমল চক্রবর্তীর এই লেখা যে কোন পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে। এই বিভাগের বাকি লেখাগুলো পাঠককে জাকির হোসেনের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য ও সংগ্রামমুখর জীবনের সাফল্যের প্রতিটি স্তর সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা দেবে বলে মনে করি।

স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন বিভাগে আরো লিখেছেন জাকির হোসেনের দীর্ঘদিনের সহকর্মী মোশাররফ হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, মাহফুজুর রহমান, মুকিতুল ইসলাম, প্রাণেশ বণিকসহ আরো অনেকে। দীর্ঘ হলেও বুরো বাংলাদেশের পরিচালক-অর্থ মোশাররফ হোসেনের তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি বুরো বাংলাদেশের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও এর সাথে জাকির হোসেনের সুদৃঢ় বন্ধন সম্পর্কে পাঠকের ধারণাকে আরো পোক্ত করবে। বুরো বাংলাদেশের ইতিহাস হিসেবে আরো বর্ধিত কলেবরে লেখাটিকে মলাটবদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে।

 

উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব জাকির হোসেনের একটি সাক্ষাৎকারও রয়েছে এ সংখ্যায়। বহু লেখকের লেখা পড়ে ধারণা নেবার পর পাঠক যখন জাকির হোসেনের ভাষ্যে তার জীবন, কর্ম ও স্বপ্নের কথা জানবেন তখন নিঃসন্দেহে অভিভূত হবেন। সাক্ষাৎকারের একটি জায়গায় জাকির হোসেন বলেছেন, ‘আমি স্বাপ্নিক তবে স্বপ্নচারী নই। অর্থাৎ, আমি সেই স্বপ্ন দেখি যা বাস্তবায়নযোগ্য। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হবে, পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও উপার্জন করবে, দারিদ্র্যের শেকল ছিন্ন করে এদেশের মানুষ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে- এটুকুই আমার স্বপ্ন।’

এছাড়া নিবেদিত কবিতা বিভাগে আছে আলম তালুকদার, আলমগীর রেজা চৌধুরী ও বাদল মেহেদীর কবিতাসহ সাতটি কবিতা। আর জাকির হোসেনের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি লিখেছেন অধুনা প্রকাশনীর সত্ত্বাধীকারী সাকী আনোয়ার।

তবে শব্দের চেয়ে চিত্রই যেহেতু বেশি শক্তিশালী তাই চতুর্মাসিক যমুনার বড় একটি আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে ‘স্থিরচিত্রে জাকির হোসেন’ বিভাগটি। ১৯৬৯ থেকে শুরু করে ২০১৭ সালের জাকির হোসেনকে পাঠক দেখতে পাবেন এ বিভাগের রঙিন পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়ে। অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় লেখার মান ও অলঙ্করণে চতুর্মাসিক যমুনা’র ‘উন্নয়ন সংগঠক জাকির হোসেন সংখ্যা’টি সংগ্রহে রাখার মত একটি প্রকাশনা। আমি যমুনার সাফল্য কামনা করছি।

চতুর্মাসিক যমুনা
সম্পাদক ও প্রকাশক: সবুজ মাহমুদ
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
শুভেচ্ছা মূল্য: ৩০০ টাকা

মন্তব্য করুণ [Comment]